গর্ভাবস্থা নারীর জীবনের একটি বিশেষ সময়, যখন শরীরে নানা হরমোনজনিত পরিবর্তন ঘটে। এই সময় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেলে সেটাকে বলা হয় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা Gestational Diabetes। সাধারণত গর্ভাবস্থার ২৪–২৮ সপ্তাহের মধ্যে এটি শনাক্ত করা যায়।
যদি এই ডায়াবেটিস সময়মতো নিয়ন্ত্রণে না আনা হয়, তাহলে এটি মা ও শিশুর উভয়ের জন্যই ভয়াবহ জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই সচেতনতা ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস বিষয়টি মনে রাখা জরুরি।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস: ঝুঁকি ও করণীয়
গর্ভাবস্থা একটি মহামূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়, যখন একজন মহিলার শরীরের প্রতিটি পরিবর্তন সন্তানের সুস্থতার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। এই সময়টিতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে মায়ের এবং শিশুর উভয়ের জন্য নানা ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা মানে শুধুমাত্র গর্ভকালীন সুস্থতা নয়, বরং ভবিষ্যতের জীবনধারার জন্যও একটি নিরাপদ ভিত্তি তৈরি করা।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিবার এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের একত্রে কাজ করা প্রয়োজন।
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস দুই ধরনের হতে পারে – প্রি-এক্সিস্টিং ডায়াবেটিস এবং গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস (GDM)।
-
প্রি-এক্সিস্টিং ডায়াবেটিস: গর্ভধারণের আগে ইতিমধ্যেই ডায়াবেটিস থাকা।
-
গেস্টেশনাল ডায়াবেটিস (GDM): গর্ভধারণের সময় প্রথমবারের মতো ডায়াবেটিস সনাক্ত হওয়া।
উভয় ক্ষেত্রেই যদি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তবে তা মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
১. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি
(ক) মায়ের জন্য ঝুঁকি
-
হাইপারগ্লাইসেমিয়া (উচ্চ রক্তে চিনি)
নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে যায়। এটি দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হার্ট, কিডনি, লিভার ও চোখের ক্ষতি করতে পারে। -
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ
ডায়াবেটিস থাকলে প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই অবস্থায় রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং প্রোটিন প্রস্রাবে দেখা দিতে পারে। এটি মায়ের জন্য প্রাণহানির কারণ হতে পারে। -
ইনফেকশন ঝুঁকি বৃদ্ধি
উচ্চ রক্তের চিনি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রস্রাব সংক্রমণ (Urinary Tract Infection), Vaginal Infection, Skin Infection ইত্যাদি হতে পারে। -
প্রসবকালীন জটিলতা
নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসে মাতৃকেও প্রসবকালীন ক cesarean section-এর ঝুঁকি বেশি থাকে। শিশুর বড় হওয়া, পেশির সমস্যা বা প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে। -
ডায়াবেটিক কমা (Diabetic Ketoacidosis – DKA)
অত্যধিক উচ্চ রক্তের চিনি যদি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না আসে, তা DKA-তে পরিণত হতে পারে, যা জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন।
(খ) শিশুর জন্য ঝুঁকি
-
Macrosomia (বড় শিশু)
মাতার উচ্চ রক্তের চিনি শিশুর জন্য অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটায়। এটি প্রসবকে জটিল করে এবং C-section বা জন্মদণ্ডের ঝুঁকি বাড়ায়। -
Hypoglycemia (জন্মের পর শিশুর রক্তে চিনি কমা)
বড় শিশুর অগ্ন্যাশয় বেশি ইনসুলিন তৈরি করে, যার ফলে জন্মের পর শিশুর রক্তে চিনি হঠাৎ কমে যেতে পারে। -
জন্মগত ত্রুটি (Congenital Anomalies)
প্রাথমিক তিন মাসে নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিসে শিশুর হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক ও কিডনিতে ত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। -
Preterm Birth (অকাল জন্ম)
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শিশুর জন্ম সময়ের আগে হতে পারে, যা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। -
Respiratory Distress Syndrome (শিশুর শ্বাসকষ্ট)
অতিরিক্ত গ্লুকোজ শিশুর ফুসফুসের বিকাশ প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে জন্মের পর শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। -
Obesity ও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি
গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচিনি শিশু ভবিষ্যতে স্থূলতা এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়।
২. গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার করণীয়
(ক) খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ
-
কম কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাদ্য
পাস্তা, সাদা রুটি, মিষ্টি কম খাওয়া উচিত। -
ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার
শাক-সবজি, বাদাম, ওটস ইত্যাদি গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। -
ছোট, ঘনঘন খাবার
দিনে ৫-৬ বার ছোট খাবার গ্রহণ রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্থিতিশীল রাখে। -
শর্করা এবং মিষ্টি সীমিত করা
জুস, সোডা, ক্যান্ডি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা।
(খ) নিয়মিত ব্যায়াম
-
হালকা হাঁটা বা যোগব্যায়াম
রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। -
ডাক্তারি অনুমোদিত ব্যায়াম
গর্ভাবস্থার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম নির্বাচন করা জরুরি।
(গ) ওষুধ ও ইনসুলিন ব্যবহার
-
ডাক্তারি পরামর্শ অনুযায়ী ইনসুলিন
খাদ্য ও ব্যায়াম নিয়ন্ত্রণে না আসলে ইনসুলিনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। -
ওষুধ সঠিকভাবে গ্রহণ
গেস্টেশনাল ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ওষুধের ডোজ মেনে চলা জরুরি।
(ঘ) নিয়মিত মনিটরিং
-
রক্তে গ্লুকোজ পর্যবেক্ষণ
Home Glucometer দিয়ে প্রতিদিন রক্তের চিনি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। -
ডাক্তারি চেকআপ
মাসে অন্তত একবার অথবা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভিজিট। -
ফিটনেস এবং ওজন পর্যবেক্ষণ
অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি রক্তের চিনি বাড়াতে পারে।
(ঙ) মানসিক স্বাস্থ্য
-
স্ট্রেস কমানো
মেডিটেশন, হালকা ব্যায়াম ও বিশ্রাম স্ট্রেস কমায় এবং রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। -
পরিবারের সমর্থন
পরিবারের সহযোগিতা গর্ভাবস্থার মানসিক চাপ কমায়।
৩. বিশেষ যত্ন ও সাবধানতা
-
গর্ভধারণের আগে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
প্রি-এক্সিস্টিং ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভধারণের আগে HbA1c পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ গুরুত্বপূর্ণ। -
গর্ভকালীন ঔষধ ও পরিপূরক গ্রহণ
প্রিসক্রিপশন অনুযায়ী ফোলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ও মিনারেল গ্রহণ। -
প্রসব পরিকল্পনা
বড় শিশুর জন্য চিকিৎসক C-section-এর পরামর্শ দিতে পারেন। -
ডেলিভারির পরে ফলোআপ
শিশুর জন্মের পরে মা ও শিশুর রক্তের চিনি পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ।
৪. উপসংহার
গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ঝুঁকি মারাত্মক, কিন্তু সঠিক খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম, ওষুধ, নিয়মিত চেকআপ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার মাধ্যমে এটি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গর্ভকালীন সঠিক নিয়ন্ত্রণ কেবল মায়ের নয়, শিশুর সুস্থতার জন্যও অপরিহার্য।
গর্ভাবস্থার প্রতিটি মুহূর্তকে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর করতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সঠিক যত্ন ও মনিটরিং শিশুকে একটি সুস্থ জীবন উপহার দেয়।