শিশুর ভাষা শিক্ষা প্রক্রিয়া একটি জটিল এবং সংবেদনশীল বিষয়, যেখানে পরিবেশ, মানুষের সংস্পর্শ, এবং সামাজিক যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা যায়, স্ক্রিন টাইম (যেমন মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার, টেলিভিশন) শিশুর স্বাভাবিক ভাষা শেখার প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদিও প্রযুক্তির কিছু সুবিধা রয়েছে, অধিক স্ক্রিন টাইম শিশুর সামাজিক দক্ষতা, ভাষা শেখার গতি, এবং ব্যক্তিগত বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিচে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো যে, কীভাবে স্ক্রিন টাইম শিশুর কথা শেখার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
১. ভাষা শেখার প্রাথমিক পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগের অভাব
ভাষা শিক্ষা প্রক্রিয়ায় মানুষের সাথে মুখোমুখি যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুরা যখন বাবা-মা বা অন্যদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে, তারা শব্দ, অভিব্যক্তি, অঙ্গভঙ্গি এবং বাচনভঙ্গি শিখে। তবে, স্ক্রিনের মাধ্যমে এই যোগাযোগের সুযোগ খুবই সীমিত হয়। স্ক্রিনে থাকা কার্টুন বা অ্যাপস শিশুদের সংলাপ শেখাতে সক্ষম হয় না, কারণ সেখানে সরাসরি প্রতিক্রিয়া বা সামাজিক ইন্টার্যাকশন অনুপস্থিত থাকে।
২. সংবেদনশীল কৌশলের অভাব
ভাষা শেখার জন্য শিশুদের স্পর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি, শব্দের স্পষ্টতা এবং উত্সাহ প্রদান প্রয়োজন। যখন বাবা-মা শিশুকে প্রতিক্রিয়া দেন, তখন শিশু শব্দের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তোলে এবং শব্দের অর্থ বুঝতে পারে। স্ক্রিনের মাধ্যমে এই বাস্তব প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় না, তাই শিশুরা সহজেই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে এবং তাদের ভাষা শেখার প্রক্রিয়ায় গতি কমে যায়।
৩. সামাজিক দক্ষতার অভাব
স্ক্রিন টাইম শিশুর সামাজিক দক্ষতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ছাড়া শিশুরা কিভাবে সামাজিকভাবে যুক্ত হতে হবে, তা শেখার সুযোগ পায় না। ফলে, তারা মুখের অভিব্যক্তি এবং কথা বলার বিভিন্ন কাঠামো সম্পর্কে কম জানে এবং বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে অসুবিধা হয়।
৪. শব্দভাণ্ডারের সীমাবদ্ধতা
শিশুরা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাদের আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে শব্দ এবং বাক্য শিখে থাকে। বাবা-মায়েরা বিভিন্ন নতুন শব্দ ব্যবহার করে, যা শিশুর শব্দভাণ্ডার বাড়াতে সাহায্য করে। স্ক্রিনে দেখানো বিষয়বস্তু সাধারণত সীমিত ভাষা ব্যবহার করে এবং এতে ভাষার বৈচিত্র্য নেই। তাই স্ক্রিন টাইম বেশি হলে শিশুরা পর্যাপ্ত নতুন শব্দ শিখতে পারে না এবং তাদের শব্দভাণ্ডার সীমিত থাকে।
৫. মনোযোগের সংকট
স্ক্রিন টাইমের ফলে শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। সাধারণত মোবাইল বা টিভি স্ক্রিনে খুব দ্রুতগতির ছবি ও শব্দ পরিবর্তন হয়, যা শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কিন্তু এই দ্রুতগতি শিশুকে বাস্তব জীবনে ধীরগতিতে শেখা প্রক্রিয়ায় মানিয়ে নিতে অসুবিধা করে তোলে। কথোপকথনের সময় মনোযোগ ধরে রাখা ভাষা শেখার জন্য জরুরি, এবং মনোযোগের ঘাটতির কারণে শিশু শব্দ, বাক্য, এবং কথোপকথনের প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে ব্যর্থ হতে পারে।
৬. ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স বা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার অভাব
শিশুরা মানুষকে দেখেই তাদের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা তৈরি করে। যখন কোনো ব্যক্তি শিশুর সঙ্গে কথা বলেন, তার মধুর কণ্ঠ, হাসি, এবং আনন্দের ভাব শিশুর আবেগীয় বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্ক্রিনে এসব অভিব্যক্তি ও আবেগ যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয় না এবং ফলে শিশুরা আবেগীয় বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়।
৭. শারীরিক ক্ষতি এবং তার প্রভাব
অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শুধুমাত্র মানসিক নয়, শারীরিকভাবেও ক্ষতিকারক। শিশুদের চোখের ক্ষতি, মাথাব্যথা, ঘুমের ব্যাঘাত ইত্যাদি ঘটে, যা ভাষা শেখার প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে শিশুরা শেখার জন্য যথেষ্ট আগ্রহ এবং মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।
৮. কল্পনাশক্তির বিকাশে বাধা
স্ক্রিন টাইম শিশুর কল্পনাশক্তিকে দমন করতে পারে। শিশুরা যখন বই পড়ে বা বাবা-মার কাছ থেকে গল্প শোনে, তখন তারা সেই গল্পের একটি চিত্র নিজের মনে আঁকার চেষ্টা করে এবং কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। স্ক্রিনে সরাসরি দৃশ্য প্রদর্শিত হওয়ায় শিশুর কল্পনার সুযোগ থাকে না, যা তাদের সৃজনশীলতা এবং কল্পনাশক্তির বিকাশে বাধা দেয়।
৯. শিখনের আনন্দের অভাব
ভাষা শেখার সময় শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে তারা এটি মজা এবং আনন্দের মাধ্যমে শিখছে। বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খেলাধুলা বা সংলাপের মাধ্যমে শিশু শব্দ এবং বাক্য শিখতে পছন্দ করে। স্ক্রিনের মাধ্যমে শেখা শিশুর জন্য মজার না হয়ে একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়, যা তাদের ভাষা শেখার আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
১০. শৈশবকালীন সামাজিক বন্ধন
শিশুরা যখন পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটায়, তখন তারা পরিবারভিত্তিক সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব বুঝতে শেখে। কথোপকথনের মাধ্যমে এই বন্ধন আরও শক্তিশালী হয়, যা শিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং সামাজিক জীবনের জন্য প্রস্তুতি তৈরি করে। স্ক্রিন টাইম বাড়লে শিশুরা পরিবারের সদস্যদের থেকে দূরে থাকে, ফলে সামাজিক বন্ধন গড়ে ওঠে না।
১১. ভাষাগত দিক থেকে সীমিত সামগ্রী
স্ক্রিনের মাধ্যমে শিশুদের জন্য তৈরি করা সামগ্রী বেশিরভাগ সময় খুবই সীমিত এবং অতি-সহজীকৃত হয়, যা শিশুদের প্রকৃত ভাষা শেখার ক্ষমতাকে তেমনভাবে বিকাশিত করে না। সাধারণভাবে, স্ক্রিনের সামগ্রীতে সীমিত শব্দভাণ্ডার, একই ধরনের বাক্যাংশ এবং সীমিত ধরনের প্রসঙ্গ ব্যবহৃত হয়। তাই শিশুরা আরও জটিল ও বৈচিত্র্যময় ভাষা শিখতে ব্যর্থ হয়।
১২. সংবেদনশীল মস্তিষ্কের বিকাশের প্রতিবন্ধকতা
শিশুর মস্তিষ্ক খুবই সংবেদনশীল এবং শেখার প্রতিটি মুহূর্তই তাদের মস্তিষ্ককে বিকাশে সহায়ক। স্ক্রিন টাইমের প্রভাবে শিশুদের মস্তিষ্ক স্থবির থাকে, কারণ স্ক্রিনের বিষয়বস্তু সাধারণত শিশুকে নতুন কিছু শেখার জন্য উদ্দীপনা প্রদান করে না। অন্যদিকে, সরাসরি যোগাযোগ শিশুদের মস্তিষ্ককে বিভিন্ন শব্দ, অনুভূতি এবং চিন্তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সচল রাখে।
১৩. শারীরিক ও মানসিক কার্যকলাপের অভাব
স্ক্রিন টাইম শিশুরা যখন টিভি দেখে বা মোবাইলের অ্যাপস নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তখন তারা শারীরিকভাবে তেমন সচল থাকে না। এই স্থবিরতা শিশুর শারীরিক উন্নতির জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। কথোপকথনের মাধ্যমে শিশুরা বিভিন্ন শব্দের অনুকরণ করতে, অঙ্গভঙ্গি শিখতে, এবং সামাজিক মানসিকতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
১৪. পারিবারিক বন্ধন হ্রাস
শিশুদের মধ্যে ভাষা শিক্ষা তখনই সফল হয় যখন তারা পরিবারভিত্তিক সামাজিক বন্ধন এবং ভালোবাসা অনুভব করে। স্ক্রিন টাইম বেশি হলে শিশুরা পরিবার থেকে দূরে থাকে এবং পরিবারের সদস্যদের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়।
১৫. সামগ্রিক বিকাশে বিলম্ব
স্ক্রিন টাইম শিশুর কথা শেখার প্রক্রিয়ার সাথে সাথে অন্যান্য সামাজিক, মানসিক এবং আবেগীয় দক্ষতার বিকাশেও বাধা দেয়। শিশুদের সামগ্রিক বিকাশে এসব দক্ষতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা পরবর্তীতে তার শিক্ষাগত এবং সামাজিক জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে।
স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণের উপায়
- সীমাবদ্ধতা আরোপ করা: প্রতিদিনের স্ক্রিন টাইম একটি নির্দিষ্ট সময়ে সীমাবদ্ধ করা উচিত।
- বিকল্প কার্যকলাপ প্রদান করা: স্ক্রিনের বিকল্প হিসেবে খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া, এবং পরিবারের সাথে মজার কার্যকলাপ যোগ করা।
- শিক্ষণীয় স্ক্রিন কন্টেন্ট বেছে নেওয়া: প্রয়োজনীয় হলে শিক্ষণীয় বিষয়